▶ ভূমিকা:— রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন, “কবিগুরু, তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই।” বাস্তবিকই, রবীন্দ্রপ্রতিভা এক পরম বিস্ময়। একইসঙ্গে তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, চিন্তাবিদ, সংগঠক এবং আরও কত কিছু। তাঁর সৃজনশীলতার বহুবিচিত্র ধারা শুধু দেশবাসীকে নয়, বিশ্ববাসীকেও মুগ্ধ করেছে, বিস্মিত করেছে।
▶ জন্ম ও শিক্ষা:— এই মহামানবের জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাতা সারদা দেবী। বালক রবীন্দ্রনাথের ছাত্রজীবন শুরু হয় ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’-তে (কারও কারও মতে ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি’)। এরপর তিনি নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতিতে বালক রবীন্দ্রনাথের মন বসত না। সেজন্য বারবার বিদ্যালয় পরিবর্তন করলেও বিদ্যালয়ের পাঠ তিনি শেষ করেননি। ১৭ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ অসমাপ্ত থাকে। প্রথাবদ্ধ শিক্ষা অসমাপ্ত থাকলেও বালক রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাচর্চায় কোনো ত্রুটি ঘটেনি। বাড়িতে যোগ্য গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন।
▶ সাহিত্যজীবন:— রবীন্দ্রনাথের কবিতা রচনার সূত্রপাত নিতান্তই অল্পবয়সে। তাঁর বয়স যখন ৭-৮ বছর, সেই সময় জ্যোতিঃপ্রকাশ নামে তাঁর এক ভাগনে তাঁকে কবিতা রচনায় উৎসাহিত করেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্য কবি-কাহিনী। তাঁর প্রথম পর্বের রচনায় পূর্ববর্তী কবিদের কিছু কিছু প্রভাব থাকলেও ক্রমশ তিনি সেই প্রভাব কাটিয়ে ওঠেন। উন্মোচিত হয় তাঁর নিজস্ব কবিসত্তা। কবিতার মতো সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও তাঁর স্বকীয়তা প্রকাশ পেতে থাকে। শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা তাঁর হাতে নতুন রূপ পায়। তিনি এককভাবে বাংলা সাহিত্যের সীমাকে অনেকদূর প্রসারিত করেন। তাঁর অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, খেয়া, গীতাঞ্জলি, বলাকা, মহুয়া, পুনশ্চ, আকাশপ্রদীপ, নবজাতক, জন্মদিনে, শেষ লেখা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বিসর্জন, শারদোৎসব, ডাকঘর, ফাল্গুনী, মুক্তধারা, রক্তকরবী প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক। তাঁর রচিত চোখের বালি, গোরা, চতুরঙ্গ, যোগাযোগ, শেষের কবিতা প্রভৃতি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বাংলা ছোটোগল্পের যথার্থ রূপটিও গড়ে উঠেছিল তাঁরই হাতে। ‘দেনাপাওনা’, ‘মণিহারা’, ‘গুপ্তধন’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প। ইংরেজি গীতাঞ্জলি (Song Offerings)-র জন্য ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘নোবেল পুরস্কার’ লাভ করেন। এই পুরস্কার তাঁকে বিশ্বজনের কাছে পরিচিত করে তোলে।
▶ সংগীতজীবন:— সংগীতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ ছিল আশৈশব। তিনি অজস্র গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন, অনেক সময় স্বকণ্ঠে গেয়ে শুনিয়েছেন সেইসব গান। তাঁর গানের কথা যেমন কাব্যগুণে সমৃদ্ধ, সুরও তেমনি আকর্ষণীয়। বাংলা গানে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন তিনি।গানের সঙ্গে সঙ্গে নাট্যচর্চাতেও তাঁর প্রবল উৎসাহ ছিল। নিজে অভিনয়ও করেছেন। পরিণত জীবনে তিনি মনোযোগী হয়েছিলেন চিত্রশিল্পে।
▶ সমাজচেতনা:— পদ্মাতীরবর্তী অঞ্চলে তিনি যখন জমিদারির কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন তখন প্রজাদের দুর্দশামোচনের উপায় খুঁজেছেন পরম আন্তরিকতার সঙ্গে। তাঁর রচনা স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অনুপ্রেরণারূপে কাজ করেছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে যখন বড়ো বড়ো রাজনৈতিক নেতারা দ্বিধা করছিলেন, তখন তিনি সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন।
▶ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা:— রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথ এই বিদ্যালয়টিকে প্রাচীন ভারতের গুরুগৃহের আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যাতে জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের সুযোগ থাকে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত কৃষিকর্ম ও পল্লি-উন্নয়ন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল শ্রীনিকেতন। শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি পল্লি-উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
▶ উপসংহার:— ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ) এই মহামানবের জীবনাবসান হয়। কিন্তু তাঁর অমর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিনিয়তই আমাদের মধ্যে বিরাজমান। আমৃত্যু মানবতার পূজারি রবীন্দ্রনাথ আজও মানবসভ্যতার পথ প্রদর্শক।
╍╍╍╍╍╍╍╍╍╍ 🌸 ╍╍╍╍╍╍╍╍╍
অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যাবহার করা একজন নবীন ছাত্র-ছাত্রি বা তাদের পিতা-মাতার কাছে চ্যালেঞ্জের মতো মনে হতে পারে, তাই আমরা এর পুরোটাই অতি সহজে এবং সম্পূর্ণ ভাবে প্রশ্ন উত্তর সহ আলোচনা করা হয়েছে। আমরা কি আপনার পরিস্থিতির সমাধান করেছি – নাকি আপনি অন্য কিছু ব্যবস্থা অনুসরণ করছেন? আমাদের অবশ্যই জানাবেন।